থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তরোগ, যা মানুষের রক্তে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে জনসাধারণের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত, থ্যালাসেমিয়া একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি প্রাথমিকভাবে বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যায়, তবে একে প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা সম্ভব হলে এটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া কী?
থ্যালাসেমিয়া হল একটি বংশগত রোগ, যেখানে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক হয়ে যায়। হিমোগ্লোবিন রক্তের কোষের মধ্যে অক্সিজেন বহন করে, আর তার অভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্ষমতা বিঘ্নিত হয়। দুই প্রকার থ্যালাসেমিয়া হয়:
অ্যালফা থ্যালাসেমিয়া
বেটা থ্যালাসেমিয়া
বাংলাদেশে সাধারণত বেটা থ্যালাসেমিয়া বেশি দেখা যায়।
থ্যালাসেমিয়ার কারণ
থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রোগ, যা সাধারণত মা-বাবা থেকে সন্তানকে চলে আসে। যদি দুজনেই থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার (অর্থাৎ রোগের একটি জিন বহনকারী) হন, তবে তাদের সন্তানের মধ্যে রোগটির পূর্ণ আক্রমণ হতে পারে। এ রোগের অন্যতম সমস্যা হল, রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন পর্যাপ্ত না হওয়া, যার ফলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে থ্যালাসেমিয়া
বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং থ্যালাসেমিয়া রোগী সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিশেষত, পারিবারিক এবং বংশগত তথ্যের অভাবে অনেক মানুষ জানেন না যে তারা থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার। এই কারণে, রোগটি ধীরে ধীরে সমাজে বিস্তার লাভ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে এ রোগের সচেতনতা কম এবং চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এর বিস্তারের অন্যতম কারণ। শহরাঞ্চলে কিছুটা সচেতনতা থাকলেও, গ্রামে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা এখনো অপরিসীম।
থ্যালাসেমিয়া চিহ্নিতকরণ
থ্যালাসেমিয়ার প্রধান উপসর্গ হলো:
রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া)
শারীরিক দুর্বলতা
ত্বক বা চোখের সাদা অংশে পীতভাব
বারবার ফিভার বা জ্বর
পেট ফুলে যাওয়া (লিভার এবং স্প্লিনের বৃদ্ধি)
থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। যদি হিমোগ্লোবিন কম থাকে বা হিমোগ্লোবিনের গঠন ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে থ্যালাসেমিয়া থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা অনেকটা রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে। সাধারণত থ্যালাসেমিয়া মেজর (বড় ধরনের) রোগীদের নিয়মিত রক্তদান এবং আয়রন ক্যামথেরাপি (Iron Chelation Therapy) করতে হয়। রক্তের অভাব পূরণ করার জন্য নিয়মিত রক্ত দেয়া প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া, নতুনত্ব হিসেবে হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনও এক সম্ভাব্য চিকিৎসা পদ্ধতি হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হলো জেনেটিক কাউন্সেলিং এবং পূর্বাভাস পরীক্ষা। যদি কোনো ব্যক্তি বা পরিবার থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার বা রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তারা শারীরিকভাবে সন্তান ধারণের আগে পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের সম্ভাবনা চিহ্নিত করতে পারে। এটি রোগের বিস্তার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল মাতৃগর্ভে পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া চিহ্নিত করা, যা বর্তমানে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে সম্ভব।
সমাধান এবং ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য জাতীয়ভাবে সচেতনতা তৈরি করা, পাশাপাশি জেনেটিক কাউন্সেলিং ও পরীক্ষার ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারি হাসপাতালগুলিতে এই রোগের চিকিৎসার পরিসর বৃদ্ধি এবং রক্তদান কার্যক্রমের সম্প্রসারণে আরো গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা কর্মসূচি এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির মাধ্যমে এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও চিকিৎসা সরবরাহ করতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া একটি ভয়াবহ বংশগত রোগ, যা সঠিক চিকিৎসা এবং সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমাদের সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে যাতে থ্যালাসেমিয়া সংক্রমণের হার কমানো যায় এবং ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম এই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।